বিস্কুট বা কুকিজের ইতিহাস জানার পূর্বে এই বিস্কুট এবং কুকিজের মাঝে পার্থক্যটা জেনে নিই–
বিস্কুটকে হতে হবে মচমচে,একটু শক্ত টাইপের।
কুকিজকে হতে হবে একটু সফট,নরম,Chewy টাইপের।
একই জিনিস,অথচ টেক্চারের পরিবর্তনে নামও পরিবর্তিত হয়ে গেছে।
কুকি নামটা এসেছে ডাচ শব্দ “koekje” থেকে,যার অর্থ “ছোট কেক”।বিস্কুট নাম এসেছে ল্যাটিন biscoctum থেকে, যার অর্থ ‘দুই দফায় বেক’ করা বা “twice baked”.
ইংল্যান্ড এবং অস্ট্রেলিয়ায় কুকিজকে বলা হয় বিস্কুট।স্পেনে বলা হয় গ্যালেটাস বা galletas.জার্মানরা বলে keks,তবে ক্রিসমাসের কুকিজকে বলে Plzchen.ইতালিতে ব্যবহৃত উপকরণভেদে নাম বিভিন্ন হয়,তবে সাধারনভাবে বলা হয় amaretti বা biscotti.
রন্ধন ঐতিহাসগণের মতে, কুকিজ বা বিস্কুটের প্রথম রেকর্ড করা হয় কেক তৈরীর জন্য ওভেনের বা চুলার তাপমাত্রা পরীক্ষা করতে।মজার না বিষয়টা?অর্থ্যাৎ,ওই সময়ে কেক তৈরীর জন্য করা বেটার বা গোলা থেকে অল্প পরিমাণে নিয়ে বেক করা হত এটা বোঝার জন্য যে কেকের জন্য চুলার তাপমাত্রা ঠিক আছে কিনা!
কুকিজ বা বিস্কুটের মূলে রোমানরা হলেও চিনি যোগে কুকিজের উৎপত্তি ইরানে।ইরানে মিষ্টি জাতীয় খাবারে সাধারনত মধু ব্যবহার করা হত।চিনির উৎপাদন শুরু হওয়ার পর অভিজাত লোকেরা চিনি মিশ্রিত কুকিজ খেত।চিনি উৎপাদনকারী আখের জন্ম ভারতীয় উপমহাদেশে হলেও এটি ভারত থেকে ইরানে নেওয়ায় ভূমিকা রেখেছেন মহাবীর আলেকজান্ডার।
ভারতীয় উপমহাদেশে মশলার সুখ্যাতির জন্য অনেক বিদেশীই এসেছে কিন্তু কেউই চিনি উৎপাদনকারী আখের বিষয়ে মনোযোগী হননি।ভারতবর্ষ দখলের উদ্দেশ্য এসে মহাবীর আলেকজান্ডার দেখলেন মৌমাছি ছাড়াই এই গাছে মধু উৎপাদন হচ্ছে।এরপর তার নির্দেশেই আমাদের ভারতবর্ষের আখ গাছকে ইরান পর্যন্ত বিস্তৃত করা হয়।তখন থেকেই মূলতঃ ইরানে চিনি তৈরি করা হয় এবং অভিজাত লোকেরা চিনি সহকারে তৈরি কুকিজ বা বিস্কুট খেতেন।
ইতিহাস পর্ব ২
চকলেট পছন্দ করেনা এমন মানুষ মেলা ভার।তো,ম্যাসাচুয়েটসে Ruth Graves Wakefield নামক এক ব্যক্তি টল হাউস রেস্টুরেন্ট পরিচালনা করতেন।তিনি ১৯৩৭ সালে কুকিজের সাথে চকলেটের চিপ মিশিয়ে তৈরি করেন নতুন স্বাদ এবং ফ্লেভারের
ক্ল্যাসিকাল_চকলেট_চিপ_কুকিজ।নতুন স্বাদের এবং মজাদার হলেও তার তৈরি এই কুকিজ দেশব্যাপী সুখ্যাতি অর্জন করে ১৯৩৯ সালের দিকে।এই সর্বপ্রথম চকলেট কুকিজের আবির্ভাব হয়েছিল। ছবিতে যে কুকিজ দেখছেন,এটার আদিপুরুষের জন্মও ওই ক্লাসিকাল চকলেট চিপ কুকিজেরই কাছাকাছি সময়ে।নাম দেওয়া হয় চকলেট_চাঙ্ক_কুকিজ।তৈরি পদ্ধতি প্রায় একইরকমের হলেও সামান্য কিছু পার্থক্য রয়েছে।পার্থক্য হল–
১.এতে অবশ্যই ব্রাউন সুগার এবং দানাদার চিনি ব্যবহার করতে হবে।
২.প্লেন চকলেট/ডার্ক চকলেটকে চৌকো করে কেটে কুকিজের ডো এ-র সাথে মেশাতে হবে।
৩.ডার্ক চকলেটে কোকোয়া সলিড থাকতে হবে অবশ্যই ৮০% বা এ-র কাছাকাছি। আমার তৈরি ছবির কুকিজকে উত্তরসূরী বললাম এরকারনেই।কেননা আমি এতে চকলেট চিপ ব্যবহার করিনি।প্লেইন ডার্ক চকলেটকে চৌকো করে কেটে ব্যবহার করেছি এবং অবশ্যই ব্রাউন সুগার এবং দানাদার চিনির সমন্বয়ে।সাথে হোমমেড আনসল্টেড বাটার তো আছেই। (তথ্যসূত্রঃ ইন্টারনেট)।
ইতিহাস পর্ব ৩
মশলাযুক্ত কুকিজ স্পাইসি কুকিজ
১৫৯৬ সালের দিকে “থমাস ডসান” রচিত “Goode Hosewife’s Jewel” নামক বইয়ে ওই সময়ে তৈরী মশলাযুক্ত বিস্কুটের পরিচয় পাওয়া যায়।গবেষকরা বলেন, রেনেসা যুগের রান্নার বইগুলো মূলতঃকুকিজের রেসিপি সমৃদ্ধ।তখনকার লোকেরা এই বিস্কুট তৈরিতে ময়দার সাথে ব্যবহার করত–
★ডিমের কুসুম
★মিস্টি মাখন
★লবঙ্গ এবং
★জয়ত্রী
মাখন বাদে সব উপকরণ মিশিয়ে ডো তৈরি করার পর সবশেষে মাখন যোগ করা হত এবং ডো বেলে ছুড়ি দিয়ে চৌকাণা শেপ করে তৈরি করত, এই কুকিজ বেক করা হত পার্চমেন্ট পেপারে।পরবর্তীতে আমেরিকায়ও এই কুকিজের প্রচলন ঘটে।অনেকেই এর সাথে ধনিয়া বীজ,বিভিন্ন সুগন্ধি হার্বও ব্যবহার করত।
বাটার_কুকিজ_শর্টব্রেড_কুকিজ
সময়ের সাথে সাথে মানুষ যত বিশ্ব সম্পর্কে জানতে শুরু করল তত মানুষ ভ্রমণ উপযোগী খাবার হিসেবে বিস্কুটকে পছন্দের তালিকার এক নম্বরে রাখতে শুরু করল,কেননা বিস্কুটকে দীর্ঘদিন সংরক্ষণ করা যায়,ক্যারি করা সহজ এবং এটি রেডী টু ইট টাইপের।
তো,আজকের আমেরিকায় বিস্কুটের প্রচলন হয় মূলতঃ ১৭-১৮ শতাব্দীতে ব্রিটিশ,ডাচ এবং স্কটিশ প্রবাসীদের হাত ধরে।আমরা এখন যে বাটার কুকিজ খাই তা কিন্তু ব্রিটিশদের টি-কেক এবং স্কটিশদের শর্টব্রেড কুকিজেরই বংশধর।বাটার কুকিজে ময়দা,চিনির সাথে তারা শুধুমাত্র সফট,ক্রিমি টেক্চারের মাখন ব্যবহার করত।মাখনের মিস্টি সৌরভ থাকা সত্ত্বেও আমেরিকানরা আবার এতে কয়েকফোঁটা গোলাপজল ব্যবহার করত সুগন্ধি করার জন্য।
ইতিহাস পর্ব (৪)
আজকে যুদ্ধ যুদ্ধ বিস্কুটের গল্প বলব।কি অবাক হচ্ছেন?ভাবছেন,কি আজব কথারে ভাই,বিস্কুটের সাথে যুদ্ধের সম্পর্ক কোথা থেকে এল!।আছে,আজকে সেই গল্পই বলব।চলুন শুরু করি
১৯১৪ সালে যখন প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়, তখন “এ্যানজাক”(অস্ট্রেলিয়া এবং নিউজিল্যান্ডের মিলিত সামরিক বাহিনী) সেনাদের মা,বোন,স্ত্রীরা তাদের বাবা,ভাই,স্বামী,ছেলেদের নিয়ে পুষ্টিগত দিক থেকে চিন্তায় পড়ে গেলেন।কেননা সেনাছাউনিতে সেনাদের যে খাবার দেয়া হবে এই দীর্ঘমেয়াদী যুদ্ধে এবং দূরতম পথে, তাতে কতটুকু পুষ্টিগুণ থাকবে আর তা খেয়ে সেনাদের শারীরিক শক্তিই কতটা থাকবে এ নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়লেন নারীগণ।
চিন্তা করতে লাগলেন কি করা যায়!এটাতো কাছের কোন পথে নয় যে রান্না খাবার পাঠানো যাবে।ফলমূলও এত দীর্ঘসময় যাবত ভালো থাকবেনা।এমনকিছু প্রয়োজন যা অনেকদিন সংরক্ষন করা যাবে,বহন করা সহজ হবে,ঝটপট খাওয়া যাবে এবং অবশ্যই পুষ্টিগুণ সম্পন্ন ও স্বাস্থ্যকর হতে হবে।চিন্তা করে দেখুন, কি ভাবনা তাদের!
তো, এই চিন্তা থেকেই তারা ময়দা,পানি এবং কিছু ড্রাই ফ্রুটের সমন্বয়ে অনেক শক্ত টেক্চারের একধরনের বিস্কুট তৈরী করলেন।অনেক শক্ত হওয়ায় এ-র সংরক্ষণের মেয়াদ হল কয়েক মাস পর্যন্ত।বিস্কুটগুলো
টিনের কৌটায় এয়ারটাইট করে সম্মিলিত সামরিক বাহিনীর সেনাদের সাথে পাঠানো হল।
১৯১৫ সালের ২৫ এপ্রিল, সেনাবাহিনী প্রায় দুই মাস সফরের পর গ্যালি পলি নামক স্থানে পৌঁছল।এবিস্কুটগুলোকে সেনারা গুড়া করে পরিজ বা হালুয়া সাথে মিশিয়ে খেত তখন।অবশ্য এমনি এমনি বা চা/কফিতে ডুবিয়েও খাওয়া হত,তবে গুড়া করে পরিজনের সাথে খাওয়ার কথাই বেশি পাওয়া যায়।তখন একে বলা হত “সোলজার’স বিস্কুট”। গ্যালিপলিতে আসার পর এর নাম হয় “এ্যানজাক বিস্কুট”। অবশ্য গ্যালিপলিতে সেইবার অস্ট্রেলিয়ান মিলিটারি বাহিনীর ইতিহাসে তাদের চরমতম পরাজিত হতে হয়েছিল।
মজার বিষয় হল,সেই শক্ত “এ্যানজাক বিস্কুট” বর্তমানে অস্ট্রেলিয়ার জাতীয় বিস্কুট।প্রতিবছর ২৫ এপ্রিল এ্যানজাক দিবস পালিত হয় এবং এই দিবস উপলক্ষ্যে ফান্ড সংগ্রহ করা হয় সেই বৃদ্ধ যুদ্ধাহতদের সাহায্যার্থে।
অবশ্য শুধু সেনাদের কাছেই এই বিস্কুট প্রিয় ছিলনা,পরবর্তীকালে জাহাজ চালক,নাবিক,ভ্রমণকারীসহ বেশ কিছু শ্রেণীর কাছে এ বিস্কুটের জনপ্রিয়তা ছিল।
ছবির বিস্কুট টাকে কেউ এ্যানজাক বিস্কুট বলে ভুল করবেন না প্লিজ।।এটা আমার তৈরি চকলেট এন্ড পিনাট বাটার কুকিজ।